কুড়িগ্রামে নামধারী সাংবাদিকের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ মানুষ।

প্রকাশিত: ৭:৪৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০১৯

এস.এম সাগর নামে এক ভূয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্মে অতিষ্ট হয়ে পরেছে এলাকার মানুষ। সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামধারী চতুর এই সাংবাদিক সমানে চালিয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজী। তার চাঁদাবাজীর হাত থেকে রেহাই পায়নি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ গরীব, দুস্থ ও অসহায় পরিবারগুলো। জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পৌরসভা এলাকার হাসেম বাজারের সোবহান আলীর পূত্র সে। নামধারী এই ভূয়া সাংবাদিকের নামে রয়েছে চাঁদাবাজীসহ একাধিক মামলা। বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার গণধোলাইয়ের শিকার হলেও বন্ধ হয়নি তার দৌরাত্ম। এই নামধারী সাংবাদিক এস.এম সাগর নিজেই অনলাইন পোর্টাল খুলে ফেঁদেছেন নিরিহ যুবকদের সাংবাদিক তৈরীর নামে প্রতারণার ফাঁদ। সরকারের অনুমোদনহীন তার নিজস্ব তৈরি অনলাইন পত্রিকা ‘স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪ডট কম’ এখন হয়েছে চাঁদাবাজীর হাতিয়ার। এছাড়াও দেশের স্বনামধন্য মিডিয়ার পরিচয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন অনৈতিক সুবিধা।

সম্প্রতি সরকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসে। এরমধ্যে জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় একটি অস্তিস্বহীণ প্রতিষ্ঠান ‘এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট’ নিয়ে জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনিয়মের বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়। এই সংবাদের সূত্র ধরে মোটা অংকের বাণিজ্য করেন এই ভূয়া সাংবাদিক। তার সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যক্ষ জানান, এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষের নিকট এসে প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে প্রচারিত সংবাদের বিপক্ষে সংবাদ প্রকাশের জন্য মোটা অংকের টাকা দাবী করেন তিনি। এক পর্যায় সমঝোতা করে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গত ৩০ অক্টোবর নামধারী সাংবাদিক এস.এম সাগর তার অনলাইনে ‘ভূরুঙ্গামারীতে এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট নিয়ে প্রকাশিত মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ‘ এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। তার সংবাদে জেলা শিক্ষা অফিসারের পদবি এবং নাম ভুলসহ তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সাফাই গাওয়া বক্তব্য দেয়া হয়। সেখানে বলা হয় সরকার চারটি শর্ত পূরণ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই চারটি শর্ত পূরণ করায় ভূরুঙ্গামারীর এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউটকে এমপিও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সে তার অনলাইন থেকে সংবাদটি মুছে ফেলেন তিনি।

জেলা শিক্ষা অফিসারের এমন উদ্ধৃতি দেয়ার বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, সাগর নামে কোন সাংবাদিক আমাকে ফোন দেননি। এবং অনলাইন পত্রিকা স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের কারো সাথেই আমার কথা হয়নি। তারা আমার নাম ভুল ব্যবহারসহ তাদের মনগড়া মন্তব্য প্রচার করেছেন। সেটি আমার বক্তব্য ছিল না। এছাড়াও এই ভূয়া সাংবাদিক সরকারদলীয় এক ছাত্রনেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হুমকী-ধামকী দিয়ে অর্থ আদায় করে নেন। কিছুদিন আগে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামতের চেক সিন্ডিকেটের হাতে; উন্নয়ন কাজ বন্ধ’ শিরোনামে সংবাদ প্রচার করা হয়। এই সংবাদের সূত্র ধরে ফুলবাড়ি উপজেলার বালারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবী করেন। শিক্ষকগণ জানান, হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করেছি। এছাড়াও তিনি নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার এমন কোন স্কুল নেই যেখানে গিয়ে টাকা তোলেননি। এরপর তিনি রাজারহাট,নাগেশ্বরী,উলিপুর ও চিলমারী উপজেলাতেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চাঁদাবাজী করেন।

এছাড়াও শিক্ষকরা জানান, সাগর সাংবাদিকের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের সাথে অনেক দলীয় প্রভাবশালী নেতার ছবি তোলা থাকে। এইসব ছবি দেখিয়ে ভূরুঙ্গামারী উপজেলাসহ জেলার অনেক প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সম্প্রতি কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীতে সাগরসহ তার সিন্ডিকেট বাহিনী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ঝুট প্লাস্টিক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোড় করে অর্থ আদায় করেন। এনিয়ে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে সিনিয়র সাংবাদিকদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেন রফিকুল ইসলাম। চতুর এই চাঁদাবাজ জেলার সুদূর রৌমারী উপজেলায় গিয়ে বেশ কিছু ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে ৫০হাজার এবং রৌমারী শুল্ক ষ্টেশন বন্দরের সংবাদ প্রকাশের জন্য ২০হাজার টাকা নিয়েছেন। এছাড়াও তিনি প্রায় সময় সরকারের উন্নয়নের কাজে অনিয়মের অভিযোগ এনে চেয়ারম্যানসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ব্লাকমেইল করে মোটা অংকের টাকা দাবী করে থাকেন।

নাগেশ্বরীতে বেসরকারি এনজিও মহিদেবে গিয়ে প্রায় চা খাওয়ানোর জন্য সাগর ২০হাজার টাকা চাঁদা দাবী করেন। না হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের ভয়ভীতি দেখান। অপরদিকে নাগেশ্বরীতে পদক্ষেপ এনজিওতে কয়েক বছর আগে ত্রাণের চাল বিতরণের সময় টাকা না হলে চালের বস্তা দাবী করেন। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা ধরে তাকে গণধোলাই দেন। সাম্প্রতিক সময়ে রৌমারীতে গিয়ে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের ভয়ভীতি দেখালে স্থানীয়রা গণধোলাই দিলে সেখান থেকেও পালিয়ে আসেন সাগর। তার বিরুদ্ধে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দৈনিক মানবকন্ঠ পত্রিকাসহ একাধিক নামে-বেনামে পত্রিকার প্রতিনিধিসহ তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে টিভি সাংবাদিকেরও পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়াও নামধারী এই সাংবাদিক সাগর এবং তার সিন্ডিকেটের সদস্য বাগভান্ডার এলাকার মশিউর রহমানে ছেলে আলতাফ হোসেন খন্দকার সাংবাদিক পরিচয়ে নাগেশ^রী বাজারে সাধারণ ব্যবসায়ী মনছুর আলীকে প্রথমে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর আবারো তার কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবী করেন। অতিষ্ঠ হয়ে ব্যবসায়ী মনছুর আলী গত ২৬ জুলাই সকালে নাগেশ্বরী থানায় একটি চাঁদাবাজী মামলা করেন। ওই দিন দুপুরে বাসষ্ট্যান্ড এলাকা থেকে সাগরকে আটক করে পুলিশ। সে ২০০৭ সালে ভূয়া র‌্যাব পরিচয়ে চাঁদা দাবী করায় ১৫ মার্চ কচাকাটা থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। এমন নানা অপকর্মে জড়িয়ে নামধারী এই সাংবাদিক মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছেন।

এ ব্যাপারে ভূরুঙ্গামারী প্রেসক্লাবের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, বর্তমানে গুটি কয়েক নামধারী সাংবাদিক সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির কারণে সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের। তারা অস্তিত্বহীন কিছুু মিডিয়ার কার্ড ঝুলিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করছেন। দেশের নামী দামী মিডিয়ার প্রতিনিধিদের দুর্নীতি ও মানবিক সংবাদ নিয়ে চাঁদাবাজি করে আসছেন। সাধারণ মানুষ সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ায় কেউ কোন লিখিত অভিযোগ না করলেও মৌখিক অভিযোগ করে থাকেন।

এই বিষয়ে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী পরিচয়ে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার প্রচুর অভিযোগ উঠছে। জেলা পুলিশ তাদের তালিকা চেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মান সম্মানের ভয়ে অনেকে অভিযোগ করতে চান না। ফলে তাদের দৌরাত্ম আরো বেড়ে গেছে। এনিয়ে মানুষের সজাগ হওয়া উচিৎ। যেন পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীদের সম্পর্কে তাদের কাছে ভুল বার্তা না যায়। পাশাপাশি প্রশাসনের উচিৎ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

এ ব্যাপারে স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থপনা পরিচালক এস.এম সাগরের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাই আমাকে আরেকবার সুযোগ দেন। আমার পেটে লাত্থি দিয়েন না। আমি আমার নিউজটা ডিলেট করেছি। এই নিউজ আমি করি নাই। এটা ঢাকা থেকে করেছে রেজা ভাই। আমি কিছুই জানিনা।

স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের ঢাকা অফিস বার্তা প্রধান এজি লাভলু’র সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাই আমি এই অনলাইনের কিছুই না। তারা আমারসহ বার্তা সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফের নাম ব্যবহার করেছে। তাকে একাধিকবার বলার পরেও সে আমাদের নাম সরিয়ে দেয়নি। তাকে বহুবার আমি রাগারাগিও করেছি নাম ব্যবহারের কারণে।